টমাস কুন তাঁর ১৯৭০ সালের প্রবন্ধ 'দ্য স্ট্রাকচার অফ সায়েন্টিফিক রেভল্যুশনস'-এ যুক্তি দেন যে, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি রৈখিক উপায়ে জ্ঞানের সঞ্চয়ের মাধ্যমে ঘটে না। বরং এটি চিন্তাভাবনার একটি অসাধারণ পরিবর্তনের ফল, যাকে তিনি প্যারাডাইম শিফট ( Paradigm Shift) বলে অভিহিত করেছেন।
কুন 'নরমাল সায়েন্স' (Normal Science) ধারণাটি প্রবর্তন করেন, যা হলো একটি প্রতিষ্ঠিত প্যারাডাইমের মধ্যে বিজ্ঞানীদের দৈনন্দিন কাজ। এই শব্দটি একদল ভাগ করে নেওয়া বিশ্বাস, তত্ত্ব, পদ্ধতি এবং মূল্যবোধকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে পরিচালিত করে। এই পর্যায়ে, বিজ্ঞানীরা বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে ধাঁধার সমাধান করেন, তত্ত্বগুলোকে পরিমার্জন করেন এবং গবেষণার পরিধি প্রসারিত করেন।
সময়ের সাথে সাথে, এই স্বাভাবিক বিজ্ঞান অনিবার্যভাবে সংকট বা অসঙ্গতির (anomalies) মুখোমুখি হয় এবং সেগুলোকে চিহ্নিত ও গ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট সাহসী হয়। পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়ার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান তত্ত্বকে ভেঙে দেয়। এটি শেষ পর্যন্ত একটি সংকটের দিকে নিয়ে যায় যা চূড়ান্তভাবে বিদ্যমান প্যারাডাইমের মূল ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ করে।
সংকট শেষ পর্যন্ত একটি নতুন উপলব্ধি বা বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের রূপ নেয়, যা পুরোনো কাঠামো থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসে এবং একটি নতুন প্যারাডাইমের জন্ম দেয়। এটি পুরোনো প্যারাডাইমের কোনো সম্প্রসারণ নয়, বরং উপলব্ধিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। টমাস কুন তাঁর বইয়ে এই ধরনের প্যারাডাইম শিফটের উদাহরণ হিসেবে জ্যোতির্বিদ্যায় কোপারনিকান বিপ্লব এবং আপেক্ষিকতার আইন সম্পর্কিত আইনস্টাইনীয় বিপ্লবকে উল্লেখ করেছেন। পৃথিবী-কেন্দ্রিক জগৎ থেকে সূর্য-কেন্দ্রিক ধারণায় পরিবর্তন শুধু জগতের একটি উন্নত বোঝাপড়াই নিয়ে আসেনি, বরং মানুষ এবং তার ঈশ্বরের সম্পর্কের ধারণাকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। একইভাবে, নিউটনীয় বলবিদ্যা থেকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক নীতিতে পরিবর্তন শুধুমাত্র বিজ্ঞানের উপলব্ধিতেই নয়, বরং সমাজবিজ্ঞানেও আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহারে পরিবর্তন এনেছিল।
কুন আরও বলেছেন যে, নতুন প্যারাডাইমে রূপান্তর শুধুমাত্র যুক্তি এবং প্রমাণের উপর ভিত্তি করে হয় না; এতে একটি সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপাদানও জড়িত থাকে, কারণ নতুন কাঠামো গ্রহণ করার জন্য বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে রাজি করানো প্রয়োজন হয়। প্যারাডাইম শিফট' এই বাক্যাংশটির সঙ্গে যুক্ত একটি সাধারণ ধারণার বিপরীতে, এই পরিবর্তনগুলো তুলনীয় বা একটি সাধারণ উৎস থেকে উদ্ভূত নয়। তারা শুধুমাত্র একটি ঘটনা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। এটি প্রায়শই একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যুক্ত থাকে। এভাবে, কুন বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে উদ্দেশ্যমূলক সত্যের দিকে একটি যাত্রা হিসেবে নয়, বরং এক প্যারাডাইম থেকে অন্য প্যারাডাইমে ধারাবাহিক রূপান্তর হিসেবে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছেন, যার প্রতিটি সেই সময়ের সমস্যাগুলোর জন্য আরও কার্যকর সমাধান দেয়।
সমালোচনা
টমাস কুনের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের তত্ত্ব প্যারাডাইম শিফটের গভীর ধারণাটি প্রবর্তন করে বৈজ্ঞানিক পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্বের উপলব্ধিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে এটি কিছু অনিশ্চয়তাও উপস্থাপন করে।
অতুলনীয়তার ধারণা (The idea of Incommensurability): কুনের প্রবর্তিত একটি মৌলিক ধারণা হলো পরিবর্তনের পরিমাপহীনতার ধারণা (incommensurability)। কার্ল পপার-এর মতো সমালোচকরা যুক্তি দিয়েছেন যে এটি বিজ্ঞানের একটি অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যায়, যেখানে একটি প্যারাডাইম নির্বাচন 'যৌক্তিক পছন্দ' না হয়ে একটি 'রূপান্তর অভিজ্ঞতা' (conversion experience) হয়ে দাঁড়ায়।
প্রত্যুষ
No comments:
Post a Comment